নির্বাচন ঘিরে আবার সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার প্রশ্ন কেন উঠে আসছে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, ততই ঘন হয় সংশয় আর জল্পনা-কল্পনার মেঘ। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচন বা সামনে থাকা স্থানীয় নির্বাচন—উভয়ের ক্ষেত্রেই আবার আলোচনায় এসেছে সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন বাস্তবতায় আমরা বারবার ফিরে আসছি কেন? কী কারণে রাজনৈতিক আস্থার সংকট কাটছে না?

বিশ্লেষকদের মতে, একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো সব অংশীজনের আস্থায় পরিচালিত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সেই নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।

এ ছাড়া প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এসব বিষয়ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে থেকেও নির্বাচনপূর্ব আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণ, বিদেশি কূটনীতিকদের মন্তব্য কিংবা রাষ্ট্রীয় সংলাপের অভাব—সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত আবহ তৈরি করছে।

সাংবিধানিক সময়সূচি অনুযায়ী নির্বাচন হবে ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়:

  • সব দল এতে অংশ নিচ্ছে কি না?

  • ভোটাররা নিঃসংকোচে তাদের মতাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে তো?

  • নির্বাচনের ফলাফল সর্বজনগ্রাহ্য হবে কি না?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই ফিরে আসে পুরোনো সন্দেহ। তাই এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছে—গঠনমূলক রাজনৈতিক সংলাপ, স্বচ্ছ প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং সর্বোপরি ভোটারদের আস্থা অর্জনের জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ।

নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েই নতুন বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রাজনৈতিক দলগুলো

জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে তো? আবারও সংশয় ও বিতর্কে রাজনৈতিক অঙ্গন

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে পুরনো সেই প্রশ্ন: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো?
বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ফের দেখা দিয়েছে সন্দেহ, সংশয় ও অনিশ্চয়তা। নির্বাচন পদ্ধতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও প্রকাশ্য বিতর্ক

অবশ্য কিছুদিন আগেও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের আস্থা ফিরে এসেছিল। ১২ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর শর্তসাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে একটি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। সে সময় বিএনপি নেতাদের বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত মিলেছিল— নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাচ্ছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনী প্রস্তুতির তৎপরতাও শুরু হয়েছিল।

এমনকি আওয়ামী বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সারাদেশে পদযাত্রা, সমাবেশ ও গণসংযোগ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠছে— আসলেই কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে? একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষক আবার ভোটের অনিশ্চয়তার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

সরকারি পর্যায়ের একাধিক উপদেষ্টা অবশ্য বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই
এদিকে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক মহলে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর পূর্ণ আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ আস্থাহীনতা থেকেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হচ্ছে।

এমন অবস্থায় আরও একটি নতুন বিতর্ক সামনে এসেছে— নির্বাচনের পদ্ধতি
সরাসরি ভোট নাকি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR) পদ্ধতি— এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে মতবিরোধ। একপক্ষ বলছে, বর্তমান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, অন্যপক্ষ চাইছে নির্বাচনি পদ্ধতির সংস্কার।

এই সবকিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও ঢেকে যাচ্ছে নির্বাচন সংশয়ের ছায়ায়

ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন

ভোট পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত, রাজনীতিতে বাড়ছে অনিশ্চয়তা ও বিভাজন

ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গনে

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভোট পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো সংসদীয় আসনে বিদ্যমান সরাসরি ভোট ব্যবস্থার পক্ষেই রয়েছে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, কয়েকটি ইসলামপন্থি দল ও কিছু বামধারার রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংখ্যানুপাতিক ভোট ব্যবস্থার দাবি তুলেছে।

এই ভিন্নমতের মধ্যেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট এবং দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকেই রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।


নতুন করে সন্দেহের জন্ম কেন?

যদিও জুনে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসবিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান–এর মধ্যে বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে শর্তসাপেক্ষে নির্বাচন আয়োজনের যৌথ ঘোষণা আসে, তখন বিএনপি ও তার মিত্রদের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। সে সময় দলটির নেতাকর্মীরা ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠা গেছে, এবং তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।

তবে যৌথ ঘোষণায় শর্ত ছিল— সংস্কার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় বিচারিক অগ্রগতি ঘটাতে হবে, তবেই রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে। অর্থাৎ, শর্ত পূরণের ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নির্ভর করছে।

লন্ডন বৈঠক এবং ঘোষণার পরপরই বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতে ইসলামিসহ অন্যান্য দলগুলো মাঠপর্যায়ে পদযাত্রা, গণসংযোগ, কর্মসূচি শুরু করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মেরুকরণ স্পষ্ট হতে থাকে

তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দলগুলোর ভেতরে এবং সাধারণ মানুষদের মাঝেও ফের প্রশ্ন জাগছে— আসলে কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে?

এমনকি ভোটারদের অনেকেই এখন এ নিয়ে সন্দিহান। তাদের জিজ্ঞাসা— নির্বাচন আদৌ হবে কি না, অথবা এটি আবারও পিছিয়ে যাবে না তো?


বিএনপির মধ্যে নতুন করে সংশয় কেন?

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে তারা মনে করছেন—

  • সরকারের পক্ষ থেকে এখনও নির্বাচনের স্পষ্ট কোনো সময়সূচি বা দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই

  • আলোচনার অগ্রগতি ও যৌথ ঘোষণার শর্ত পূরণে আশানুরূপ উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না

  • অন্যদিকে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে

ফলে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের মধ্যে আবার নতুন করে সংশয় ও সতর্কতা ফিরে এসেছে।


এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থার জন্য প্রয়োজন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনা এবং সময়মতো স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে লন্ডনে বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয় গত ১২ই জুন

নির্বাচন নিয়ে সন্দেহের পেছনে সরকারের ভূমিকা— অভিযোগ বিএনপি নেতাদের

ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির পরও নেই স্পষ্টতা, তৃণমূলে হতাশা

বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা—এই অঞ্চলগুলোতে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী। এসব জেলায় দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে নতুন করে সংশয় তৈরি হয়েছে, আর এর জন্য তারা মূলত সরকারের ভূমিকাকেই দায়ী করছেন।

তাদের অভিযোগ, লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে শর্তসাপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের যৌথ ঘোষণা আসার পর প্রায় তিন সপ্তাহ পার হলেও সরকার বা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি

এ বিষয়টি নিয়ে শুধু তৃণমূল নয়, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা-ও অনানুষ্ঠানিক আলাপে একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তা নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

সর্বশেষ, কয়েকদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সেই বৈঠকেও নির্বাচনের সময়সূচি বা স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নিয়ে কোনো কিছু জানানো হয়নি।

সাক্ষাতের কয়েক দিন পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে আমরা ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
বিবিসি বাংলার সঙ্গেও তিনি একই কথা বলেন।

এই মন্তব্যই আরও ধোঁয়াশা তৈরি করেছে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, একবার জুন, পরে এপ্রিল, আর এখন বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—বারবার সময় পরিবর্তনের কারণে নির্বাচনের সময়কাল নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।


‘সরকারের মধ্যেই দোটানা রয়েছে’— বিএনপি নেতাদের অভিমত

তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, সরকার নিজেই দ্বিধায় রয়েছে। তারা অভিযোগ করছেন, সরকার একদিকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখালেও অন্যদিকে কার্যকর কোনো অগ্রগতি করছে না।

তবে কিছু কেন্দ্রীয় নেতা অপেক্ষাকৃত সংযত। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে এবং সে অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে।”

রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপির অনেক নেতাই মনে করছেন, লন্ডন বৈঠকের পর সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। কারণ, বহুদিন পর ক্ষমতাকেন্দ্রের খুব কাছে যাওয়ার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।

তাই দলটি এখন ধৈর্যের সঙ্গে কৌশলে সামনে এগোতে চাচ্ছে। তবে এত কিছুর পরও নির্বাচন ঘিরে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে— যা স্পষ্টতই বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতার মধ্যে বিদ্যমান।

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা: সরকারের দ্বিধা, বিভক্ত রাজনৈতিক পন্থা

বিএনপির মিত্র দলগুলোও ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিরাজমান অনিশ্চয়তা ও ধোঁয়াশার বিষয়টিকে একইভাবে দেখছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, "সরকারের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে স্পষ্ট দ্বিধা রয়েছে। এই দ্বিধাই ধোঁয়াশা তৈরি করছে।"

তিনি মনে করেন, সময় মতো নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সরকারের দোলাচলের কারণেই রাজনৈতিক মাঠে আস্থার সংকট বাড়ছে।


বিশ্লেষকরা বলছেন: রাজনৈতিক ঐকমত্যে ব্যর্থতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। একজন বিশ্লেষক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার এখনো সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষকে এক ছাতার নিচে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি, মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনকেও এখনও সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত করা যায়নি। এতে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, এসব অস্বচ্ছ পরিস্থিতিই সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয় বাড়িয়ে তুলছে।

অন্যদিকে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, “ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু সামনে এনে আসলে অনিশ্চয়তা বাড়ানো হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন না করার দাবি এসব বিতর্কের মূল কারণ হয়ে উঠছে।”

বিএনপি নেতারাও এই দাবিগুলোর প্রসঙ্গ টেনে বলছেন, নির্বাচনের পদ্ধতি ও সময় নিয়ে জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে, যা তাদের সন্দেহের অন্যতম উৎস।


ভোট পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট বিভক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ভোট পদ্ধতি নিয়েও স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস (মামুনুল হকপন্থী) এবং নুরুল হক নূরের গণঅধিকার পরিষদ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR) নির্বাচন পদ্ধতি চালুর দাবি জানিয়ে এক ধরনের সমন্বিত অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা চাই, এবারের জাতীয় নির্বাচনে থেকেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি কার্যকর হোক।”

এই প্রস্তাবনার বিপরীতে বিএনপি ও তার মিত্ররা এখনো সরাসরি আসনভিত্তিক ভোট ব্যবস্থাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পথে আরেকটি অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।


এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দলগুলোর অভিন্ন অবস্থান গড়ে না উঠলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে, এবং সাধারণ ভোটারদের আস্থাও হুমকির মুখে পড়বে।

জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলাে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির দাবিকে সামনে এনেছে

নতুন ভোটপদ্ধতির দাবিতে রাজনৈতিক চাপ তৈরির চেষ্টা, বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ইসলামপন্থী দলগুলোর

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) ব্যবস্থা চালু ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় ভোটের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে দেশের কয়েকটি ইসলামপন্থী ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল। সংশ্লিষ্ট দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তারা শুধু সরকারের ওপর নয়, বিএনপির দিকেও চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন

এই দলগুলোর একটি অংশ মনে করে, নির্বাচনের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে আনার মাধ্যমে তারা নিজস্ব রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করাও তাদের কৌশলের অংশ।


সমাবেশে জামায়াত-খেলাফত, বাদ বিএনপি

সম্প্রতি ঢাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি সমাবেশ আয়োজন করে, যেখানে আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালু ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়। এই সমাবেশে জামায়াতে ইসলামি, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদসহ একাধিক দল অংশ নেয়। তবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি

ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যেহেতু বিএনপি আসনভিত্তিক সরাসরি ভোটের পক্ষে, তাই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অন্যদিকে, বিএনপি নেতারাও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তারা PR ব্যবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না


পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বিভক্ত রাজনীতি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই মতপার্থক্য রাজনীতিতে বিভাজন ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, যার ফলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও অবস্থান রাজনীতিতে সমন্বয়হীনতা তৈরি করছে, যা নির্বাচনকালীন আস্থা সংকটকেই বাড়িয়ে তুলছে।


ভোট পদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন মত: ইসলামি দল বনাম বিএনপি

বর্তমানে ইসলামি দলগুলো বিশেষভাবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ভোট ব্যবস্থা (PR) চালুর পক্ষে।
তাদের মতে, এই ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিফলিত হয়, ফলে অন্যায়ের সুযোগ কম থাকে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, “PR ব্যবস্থায় একক কর্তৃত্বের জায়গা থাকে না, বরং সকল ভোটই মূল্যায়িত হয়।”

অন্যদিকে, প্রচলিত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থায় কোনো দল যদি ৫১% ভোট পায়, তবে তারা এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে, এবং বাকি ৪৯% ভোটারের প্রতিনিধি দলগুলো কার্যত প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। ইসলামি দলগুলোর যুক্তি—এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।


এনসিপি: সংসদের উচ্চকক্ষে PR পদ্ধতির পক্ষে

এদিকে, উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP) সংসদের উচ্চকক্ষে PR পদ্ধতির প্রয়োগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তবে তারা সংসদের নিম্নকক্ষে প্রচলিত আসনভিত্তিক সরাসরি ভোটের পক্ষে রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব


এই ভিন্নমত, দ্বিধা ও দোলাচলের মাঝে রাজনৈতিক অঙ্গন যেন আরও বেশি বিভক্ত হয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যমত না গড়ে ওঠে, তবে নির্বাচন কেবল সময় নয়, আস্থার দিক থেকেও কঠিন সংকটে পড়বে

আনুপতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে অনেক দল

আনুপাতিক ভোট পদ্ধতির দাবিতে বিতর্ক, প্রলম্বিত নির্বাচনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিল জামায়াত

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR) ভোট পদ্ধতির দাবিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে। বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এই দাবিকে নির্বাচন প্রলম্বিত করার কৌশল হিসেবে দেখলেও, জামায়াতে ইসলামি এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ভোট পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী
দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “আমরা এমন একটি প্রস্তাব দিয়েছি যাতে কোনো দল যদি মাত্র ১% ভোটও পায়, তা হলেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব পাবে।”
এর ফলে ক্ষুদ্র দলগুলোর জন্য রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে বলেই তারা মনে করছেন।


ক্ষুদ্র দলের স্বার্থ ও PR পদ্ধতির বাস্তবতা

আসনভিত্তিক সরাসরি ভোট পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোর পক্ষে সংসদে প্রবেশ কঠিন। সে কারণে ইসলামী দলসহ কিছু বাম রাজনৈতিক শক্তিও PR ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
PR পদ্ধতিতে ব্যালটে প্রার্থী নয়, বরং দলীয় প্রতীকেই ভোট দেওয়া হয়, এবং প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলো সংসদে আসন পায়।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯১টি দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও রয়েছে।


PR ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি ও মিত্রদের আপত্তি

অন্যদিকে, বিএনপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ দলগুলো বলছে, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতায় এখনই PR পদ্ধতি চালু করা সম্ভব নয়।
তাদের মতে, এই পরিবর্তনের জন্য কমপক্ষে এক দশক সময় নিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুতি নিতে হবে।
বিএনপি নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, “ভোটাররা যদি সরাসরি এলাকার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারেন, তবে গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক চেতনা বিঘ্নিত হবে।”


দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব ও ঐকমত্য

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে একমত হয়েছে।
তবে কক্ষ দুটি কীভাবে গঠিত হবে, সে বিষয়ে বিভাজন রয়ে গেছে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন,

“কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে—নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোট বহাল রাখা এবং উচ্চকক্ষে PR পদ্ধতি চালুর।”

তবে বিএনপি বলছে, উচ্চকক্ষেও দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া যেতে পারে, PR নয়। তারা উচ্চকক্ষে আনুপাতিক ভোট ব্যবস্থার বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।


সরকারি অবস্থান ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি

সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে ভোট পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা এখনও হয়নি।

তারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতেই সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে

এদিকে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।


রাজনৈতিক অনৈক্য ও সমন্বয়ের অভাবেই বাড়ছে অনিশ্চয়তা

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং সরকারের মধ্যকার সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

সরকারের এক বছর পার হতে চললেও এখনও পরিকল্পনাগত ঐক্য বা সুস্পষ্ট রোডম্যাপ অনুপস্থিত। যার ফলে একের পর এক ইস্যু সামনে আসছে এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে



 

No comments

হতাহতদের সেবায় এগিয়ে আসুন, রক্তদান করুন

  হতাহতদের সেবায় এগিয়ে আসুন, রক্তদান করুন       ঢাকা মেডিক্যাল বার্ন ইউনিট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, কু...

Theme images by mariusFM77. Powered by Blogger.